মিলির হাতে একটা বই '' নতুন শিশুর যত্ন '', কাল সাহেদ এনে দিয়ে বলল এখনি শিখে রাখো বুঝলে। কিন্তু মিলি বইতে মন দিতে পারছে না , কত কথা মনে পড়ছে বিছানায় শুয়ে থেকে , যেদিন এই বাড়িতে প্রথম এলো সেদিনের কথা থেকে শুরু করে সব কিছু । শাশুড়ির বাঁকা বাঁকা কথা গুলো এখনো মনে হলে খুব কষ্ট হয় , অথচ কতটা পাল্টে গেছেন এই কদিনে শাহানা বেগম মানে মিলির শাশুড়ি । আর সাহেদ কতটা পাল্টেছে তার যেন হিসাবই মেলাতে পারে না মিলি , কি আদুরে ভঙ্গিতেই না কথা বলে আজকাল সাহেদ মিলির সাথে ।
একটি মাত্র সংবাদ পাল্টে দিল মিলির জীবন, হয়ত সাহেদের ও নাহলে সাহেদ কে এত নতুন মনে হয় কেন , নতুন বাবা হবার খুশিতে সাহেদ তো আজকাল দিশাহারা । কি করবে না করবে, কিভাবে মিলির সব সমস্যা দূর করবে তাই যেন সারাক্ষণ ভাবছে , আর শাশুড়ি তো যত্নের চূড়ান্ত করছেন ।
''বৌমা দুধটুকু খেয়ে নিও'' টেবিল এ গ্লাসটা রাখতে রাখতে বললেন শাহানা বেগম , '' আর সারাদিন শুয়ে থাকলেই কি শরীর ভালো হবে , একটু হাটাচলাও তো করতে হবে ' কিছুটা উপদেশের স্বরে বলা কথা গুলো শুনে মিলি উঠে বসে , গ্লাসটা হাতে নিয়ে কছুক্ষন তাকিয়ে থাকে দুধের দিকে । দুধ খেতে এত কষ্ট কখনো হয়নি জীবনে , কি বিস্বাদ ।
মিলির বিয়ে হয়েছে তিন বছর হয়েছে গত জানুয়ারিতে , সাহেদ একটা প্রাইভেট বাংক এ চাকরি করছে , বাবা না থাকায় সংসারের দায়িত্ব বড় ছেলে হিসাবে সাহেদের উপর । সেতু আপা মানে সাহেদের বড় বোন থাকে মিরপুরে শশুরবাড়িতে , মাঝে মাঝেই বেড়াতে আসে , তবে আগে কখনই মিলির সাথে তেমন একটা কথা টথা বলত না , আজকাল প্রায় ফোনে খোজ নেন , মিলির শরীর কেমন , মাথা ঘোরানো কমেছে কিনা এইসব । সাহেদের ছোট ভাই শাহীন , একটা ভালো কলেজ এ অনার্স পরছে , এই দেবরটা খুবই ভালো, আগেও যেমন মিলিকে সম্মান করত , এখন যেন সেটা আরো বেড়ে গেছে ।
এই যে সবার মাঝে এত পরিবর্তন সেটা শুধু একটা সুসংবাদের জন্য , মিলির শরীরে বেড়ে উঠছে আরো একটা নতুন প্রাণ, মা হতে যাচ্ছে মিলি । শাশুড়ির এত দিনের ইচ্ছা পূরণ হতে যাচ্ছে , যে ইচ্ছার কথা বিয়ের পাঁচ মাসের মাথায় মিলিকে জানিয়েছিলেন শাহানা বেগম, '' তোমার শশুর তো কিছুই দেখে যেতে পারল না , আমি যেন সাহেদের সন্তান দেখে যেতে পারি'' শাশুড়ির এই কোথায় মিলি কিছুটা অসহায় চোখে তাকিয়েছিল , কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারে নাই । এর কিছুদিন পর সাহেদ যখন মায়ের ইচ্ছার কথা বলে মিলিকে বুঝতে লাগলো একটা সন্তান নেবার জন্য, মিলির ইচ্ছা না থাকলেও সাহেদের মুখের দিকে তাকিয়ে রাজি হয়ে যায় মিলি , আর তখন থেকেই তার জীবনে শুরু হয় এক নতুন টানাপড়েন ।
বিয়ের তিন বছরে ও মা হতে পারে নাই মিলি , আর সে দিন গুলোতে কারো কাছ থেকেআশার কথা দুরে থাক সামান্য সান্তনা পর্যন্ত পায় নাই , সাহেদ মাঝে মাঝে সন্তান পাবার চেষ্টা জারি রাখতেই হয়তো মিলির কাছাকাছি হয়েছে কিন্তু কোথায় যেন তাল-লয় কেঁটে গিয়েছিল ওদের মাঝে ।
আর আজকাল সব কিছু নতুন ভাবে ধরা দিচ্ছে মিলির কাছে , সবার কত ভালো ভালো কথা , কিভাবে চললে সব ভালো হবে , কি করা ঠিক না কত উপদেশ , মাঝে মাঝে খারাপ লাগে আবার ভালোও লাগে ।এমনি কি কাজের মহিলাটি সুযোগ পেলেই কতরকম উপদেশ দেবার চেষ্টা করে , ''দুধ বেশি কইরা খাইয়েন আফা , তাইলে বাচ্চার গায়ের রং সুন্দর অইব '' কত দিন যে বলেছে বেচারী ।
নতুন একটা জীবনের অস্তিত্ব যখন টের পেল মিলি নিজের মাঝে , তখন একটা ঘোরের মাঝে ছিল কত দিন । খাবারে অরুচি, মাথা ঘোরা , কিছু খেলেই বমি করে দেয়া সব মিলে কিভাবে যে একটা মাস কাটল মনেই করতে পারছে না মিলি । মিলির সব চেয়ে ভালো লাগে সাহেদের নতুন রূপ , যেন সেই পৃথিবীর প্রথম বাবা হতে যাচ্ছে , অফিস থেকে কতবার যে ফোন করে তার ঠিক নেই । মাঝ খানের দুইটা বছর এই মানুষটাই কেমন যেন সব সময় এড়িয়ে চলতো বাসার সবাইকে এমন কি মিলিকেও ।
ওদিকে মিলির বাবা মা যেন এই নতুন খবরে , নতুন করে বাঁচতে শুরু করেছেন । সেদিন তো মিলির বাবা অসুস্থ্য শরীর নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় চলে এলেন মেয়েকে দেখতে , সাথে মায়ের দেওয়া আচার , তিলের নারু , পিঠা আরো কতকি । বাবার সাথে কখনই মিলিদের ভাই বোন কারো তেমন বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল না , কিন্তু সেদিন বাবা মিলির সাথে অনেক গল্প করলেন , নানা খুটি নাটি বিষয়ে কথা বললেন, এটাও মিলির জন্য নতুন একটা পাওয়া ।
আজ বাসায় কেও নেই , শাশুড়ি গেছেন মেয়ের বাড়ি , সাহেদ এখনো অফিস থেকে ফিরেনি । কাজের বুয়া চলে যায় দুপুরেই ..........বাসার মিলি একা । টিভির সামনে বসে কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে একটা অনুষ্ঠান দেখে , তারপর আবার হারিয়ে যায় ভাবনার রাজ্যে ...
'এই এত কি ভাবছো ? শরীর ঠিক আছে তো ?'' সাহেদের কথায় চমকে তাকায় মিলি , ''কখন এলে '' প্রশ্ন করে । টিভি দেখতে বসে কোথায় যে হারিয়ে গিয়েছিল মিলি , সাহেদ অফিস থেকে ফিরেছে খেয়াল করে নাই......''.বাসায় বোধ হয় কেও নেই '' মিলির দিকে ভালবাসার হাত বাড়ায় সাহেদ , মিলিও নিজেকে সাহেদের বুকে সপে দেয় , অনেক ক্ষণ সাহেদ মিলিকে বুকের সাথে জড়িয়ে বসে থাকে , এক সময় ফিসফিস করে বলে '' তুমি আমার জীবনকে একটা নতুন ভাল লাগায় ভরে দিলে মিলি , আমি তোমাকে খুব .......... ''। খুক খুক কাশির শব্দে মিলি সাহেদ দুজনই প্রায় লাফিয়ে দুদিকে সরে যায় ......কখন যে শাহীন এসে দরজায় দাড়িয়েছে কেও খেয়াল করে নি ।